
প্রকাশিত: Sat, Jan 21, 2023 3:08 PM আপডেট: Sat, Jun 28, 2025 6:37 AM
প্রকৃত শিল্পী ও শিল্পের প্রতি কি আমাদের মমতা আছে?
সুজিত মোস্তফা
আমাদের সংস্কৃতির মূল ধারার যে সংগীত, নৃত্য এবং অন্যান্য বিষয় সেগুলোর চর্চা আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেছে। লেখাপড়ার ভয়াবহ চাপ, কোচিং এবং সন্তানদের জিপিএ গোল্ডেন ফাইভ পাওয়ানোর জন্য অভিভাবকদের লাগামহীন প্রচেষ্টা তাদের সন্তানদের প্রকৃত মানুষ করে গড়ে তুলবার ক্ষেত্রে যে বিপুল বাধার সৃষ্টি করছে, ঠিক তেমনিভাবে সামগ্রিক সাংস্কৃতিক উন্নয়নও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। মনে রাখতে হবে, শুধু একাডেমিক্যালি তথাকথিত শিক্ষিত সন্তান তৈরি করলে হবে না। একটি দেশের পরিবেশ এমন হওয়া উচিত যেন সেই সন্তান তার মানবিক বিকাশ ঘটিয়ে, মানবিকভাবে অন্য মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে এবং অন্য মানুষের সমর্থন নিয়ে একটি সুশৃঙ্খল সৎ জীবন যাপন করার মাধ্যমে দেশ, মানুষ ও সমাজ গড়ার পরিবেশ পায় এবং নিজেও একটি সৎ, সমৃদ্ধ ও সুন্দর জীবন যাপন করার সুযোগ পায়। ইসলাম ধর্মের অপব্যাখ্যা করে নানান হাদিসের দোহাই দিয়ে ছোট বাচ্চাদেরকে বোঝানো হচ্ছে যে সংগীত হারাম যদিও আমার জানামতে কোরআন শরীফের কোন জায়গায় সংগীত শব্দটিই নেই। সংগীতে অশ্লীলতা হারামের কথা বলা হয়েছে কিন্তু অশ্লীলতাতো যেকোনো বিষয়েই হারাম, শুধু সঙ্গীতকে দোষ দেওয়া কেন?
ঘুষ খাওয়া, ব্যভিচার, মদ্যপান, প্রতারণা, প্রবঞ্চনা, সুদ খাওয়া, এতিমের হক মেরে দেওয়া, চুরি করা, মিথ্যা বলা, সবই পাপ এবং এর মধ্যে অনেকগুলো রীতিমতো হারামের পর্যায়ে পড়ে, সেগুলো নিয়ে আমাদের ধর্মীয় সমাজকে ততোটা উচ্চকণ্ঠ হতে দেখি না। সত্যি যদি একটি প্রকৃত সুস্থ সমাজ আমরা চাই যেখানে ইসলামী মূল্যবোধ, ধর্মীয় মূল্যবোধ নিয়ে আমাদের বিকাশ ঘটবে তাহলে এই সমস্ত অন্যায়গুলোর বিরুদ্ধে আমাদের আরও বেশি সোচ্চার হওয়া উচিত। সংস্কৃতি চর্চার ক্ষেত্রে আরো একটি বড় বাধার জায়গা হচ্ছে সংস্কৃতি কর্মীদের অবমূল্যায়ন। সরকারিভাবে বাংলাদেশের সংস্কৃতি কর্মীদের উপার্জনের জায়গা হচ্ছে বাংলাদেশ টেলিভিশন, বাংলাদেশ বেতার এবং বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী। আপনারা জেনে বিস্মিত হবেন যে বাংলাদেশ বেতারে এখনো একজন টপ গ্রেড আর্টিস্ট এর একটি প্রোগ্রামে সঙ্গীতের ক্ষেত্রে প্রাপ্য সম্মানি হচ্ছে মাত্র ১৩৫০ টাকা। একজন গ্রন্থিক সেখানে একটি কথিকা পড়ে পান মাত্র ৩০০ টাকা। এটাতে তাদের যাতায়াত খরচও ঠিক মতন হয় না। তাহলে কীভাবে এবং কেন এদেশের মানুষ সংগীত বা সংস্কৃতি চর্চায় উৎসাহিত হবে? টেলিভিশনে টপ গ্রেড একজন আধুনিক, নজরুল সংগীত, রবীন্দ্র সংগীত বা লোকসঙ্গীত শিল্পী একটি অনুষ্ঠানে আগে ৬০০০ টাকা পেতেন।
আমাদের দীর্ঘদিনের আন্দোলনের ফলে এই টাকার পরিমাণ দ্বিগুণ করা হয়েছিল। দ্বিগুণ করার পর দেখা গেল যে আগে ৫০ মিনিটের হিসাবে পেমেন্ট দেয়া হতো। এখন সেটিকে ২০ মিনিটের হিসাবে দেয়া হচ্ছে কিন্তু সময় কমানোর জন্য সেই ৬০০০ টাকা দ্বিগুণ হয়ে হয়ে গিয়েছে পাঁচ হাজার টাকা। কি নিদারুণ পরিহাস এবং অবহেলা! বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর প্রতিটি জেলাতে শাখা আছে এবং সেই শাখা গুলোতে সংগীত, যন্ত্রসংগীত এবং নৃত্যের প্রশিক্ষক রয়েছেন। জেনে অবাক হবেন যে এই সমস্ত প্রশিক্ষকদের মাসিক বেতন মাত্র ২৩০০ টাকা। দীর্ঘদিন ধরে তাদের বেতন অন্তত ১০ হাজার টাকা করার দাবি আমি জানিয়ে আসছি আমার সীমিত অবস্থান থেকে। সেটি সচিব, মন্ত্রী কোন পর্যায়ে বলতে বাকি রাখিনি। বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন আছে, শীঘ্রই হয়ে যাবে, এই সমস্ত কথা শুনে আসছি বছরের পর বছর কিন্তু কোনো ফল নেই এবং আমাদের শিল্পীরাও ঐক্যবদ্ধ হয়ে যে আন্দোলন করবে সেটুকু ক্ষমতাই তাদের নাই। তাদের অর্থনৈতিক ভিত্তি এতই দুর্বল যে তারা একটু সাহস করে, ঐক্যবদ্ধ হয়ে বা এককভাবে নিজের দাবিটিও জানাতে পারেন না।
আমরা যদি শোষণ মুক্ত বাংলাদেশ চেয়ে থাকি তাহলে শিল্পীদের উপরে এটি একটি ভয়াবহ শোষণ নয় কি? বিভিন্ন প্রাইভেট টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে আমরা আমাদের ঐতিহ্য ভিত্তিক সংস্কৃতি কেন্দ্রিক কোনো স্পনসর্ড প্রোগ্রাম দেখি না। বলতে গেলে আমাদের রবীন্দ্র সংগীত, নজরুল সংগীত আমাদের বেসিক বাংলা গান, উচ্চাঙ্গ সংগীত, উচ্চাঙ্গ নৃত্য ইত্যাদির প্রচার প্রসারে কোন স্পন্সরকেই এগিয়ে আসতে দেখি না। আমরা পার্শ্ববর্তী দেশের রিয়েলিটি শোগুলোতে ছোট ছোট বাচ্চাদের দুর্দান্ত সংগীত, নৃত্যের পারফরম্যান্স দেখে বাহা বাহা করে গলে যাই অথচ আমাদের তরুণদের মধ্যেও এরকম সম্ভাবনাময় অনেক প্রতিভা আছে যাদেরকে আমরা ঠিক মতন প্ল্যাটফর্মই দিচ্ছি না। আমাদের মূল ধারার সাংস্কৃতিক সত্ত্বার প্রচার, প্রসার, বিকাশ ঘটাতে আমরা বিন্দুমাত্র আগ্রহী নই। আমাদের স্পন্সররা কি কারণে আমাদের দেশের সংস্কৃতি প্রচার প্রসারে এগিয়ে আসছেন না জানিনা। প্রতিটি চ্যানেলে যদি দিনে অন্তত একঘন্টা করে আমাদের দেশীয় সংস্কৃতি প্রচারের সুব্যবস্থা থাকতো এবং সম্মানজনক সম্মানী থাকতো তাহলেও তো শিল্পীরা একটা উৎসাহ পেতেন যে হ্যাঁ এটা চর্চা করলে অন্তত জীবন ধারণ করে দেশ ও সংস্কৃতির জন্য কিছু করা যাবে। সকল ক্ষেত্রে মানুষের উপার্জন বেড়েছে।
শুধু শিল্পীদের ক্ষেত্রে সেটি ক্রমাগত নিম্নগামী আর প্রযুক্তির ভয়াবহ উন্নয়নে আগে যেরকম সিডি, ক্যাসেটের একটা ব্যবসা ছিল সব ইউটিউব বা ইন্টারনেটের দুনিয়ায় চলে যাওয়ায় বেশিরভাগ শিল্পীকে তাদের সৃষ্টিগুলো নিজস্ব খরচে তৈরি করে নিজেই আপলোড করতে হচ্ছে এবং এগুলোর উপরে কোন নিয়ন্ত্রণ না থাকায় অশ্লীল কুরুচিপূর্ণ ভিডিও আপলোড হয়ে যাচ্ছে অনেক বেশি। মিডিয়ার ভূমিকা ছিল সভ্যতা বিকাশের জন্য সুশৃংখলভাবে রুচিশীল সৃষ্টি সমূহের বিস্তার ঘটানোর মাধ্যমে মানব রুচি উন্নয়ন করা। এখন ঘটছে উল্টোটা। আমরা সভ্যতার বিকাশ ঘটানোর বদলে ক্রমাগত অসভ্যতার বিকাশ ঘটিয়ে যাচ্ছি। প্রকৃত শিল্পীদের জন্য কোনো সুব্যবস্থা নাই এবং এভারেজ ফালতু জিনিস ইন্টারনেটে ব্যাপক প্রচার পাচ্ছে। জনগণকে নিম্ন রুচির আইটেম সমূহের প্রতি আকৃষ্ট করা হচ্ছে।
শিল্পী এবং শিল্প ধ্বংস হচ্ছে পাশাপাশি। অখাদ্য উপাদান সমূহে নেটের দুনিয়া ভরে যাচ্ছে, সেখানে অল্প যা কিছু ভালো আইটেম আপলোড হয় ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় বা কোনো কোনো কোম্পানির প্রচেষ্টায় সেগুলোর ভিউ এতই কম এবং ভিউই যেহেতু বিচারের মাপকাঠি সেখানে আমাদের মূল ধারার সংস্কৃতি সামগ্রিকভাবে কি ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন সেটা কে আন্দাজ করবে, কার দায়িত্ব? আমি মনে করি এটি রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব। আমাদের মিনিস্ট্রি গুলো যারা এ্যাটলিস্ট সাংস্কৃতিক বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করে তার মধ্যে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়, তথ্য মন্ত্রণালয় এবং অবশ্যই অর্থ মন্ত্রণালয় রয়েছে, তাদের সংযুক্তভাবে কাজ করে এই সমস্যাগুলোর সমাধান করা উচিত। কিন্তু তাদের কানে এ কথাগুলো কে ঢোকাবে? তারা কিন্তু জানেন না তা নয়। তারা জানেন কিন্তু শিল্পী এবং শিল্পের প্রতি তাদের বিন্দুমাত্র মমতা আছে বলে আমার মনে হয় না। এই মমতা সৃষ্টির জন্য আমাদের কি করা উচিত কেউ কি বলে দিতে পারবেন? লেখক: সংগীতশিল্পী
আরও সংবাদ
চ্যাম্পিয়ন ভারত : একটা ছোট মুহূর্ত কতো বড় পার্থক্য গড়ে দিতে পারে
‘ওই ক্যাচ হয়নি, সুরিয়াকুমারকে আবার ক্যাচ ধরতে হবে’!
কতো দেশ, কতোবার কাপ জিতলো, আমাদের ঘরে আর কাপ এলো না!
সংগীতাচার্য বড়ে গোলাম আলি খান, পশ্চিমবঙ্গের গর্ব সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় ও আমি
ইন্ডিয়ান বুদ্ধিজীবী, ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ও দেশের বুদ্ধিজীবী-অ্যাক্টিভিস্ট
মতিউর প্রতিদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ৮৩ ব্যাচের বন্ধুদের গ্রুপে সৎ জীবন যাপনের উপদেশ দিতেন!

চ্যাম্পিয়ন ভারত : একটা ছোট মুহূর্ত কতো বড় পার্থক্য গড়ে দিতে পারে

‘ওই ক্যাচ হয়নি, সুরিয়াকুমারকে আবার ক্যাচ ধরতে হবে’!

কতো দেশ, কতোবার কাপ জিতলো, আমাদের ঘরে আর কাপ এলো না!

সংগীতাচার্য বড়ে গোলাম আলি খান, পশ্চিমবঙ্গের গর্ব সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় ও আমি

ইন্ডিয়ান বুদ্ধিজীবী, ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ও দেশের বুদ্ধিজীবী-অ্যাক্টিভিস্ট
